জামায়াতের সাথে সালাত আদায়ের গুরুত্ব
সালাত, আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থ দু’আ, তাসবীহ, রাহমাত কামনা, ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) দয়া, ইত্যাদি।
শারী’আতের পরিভাষায় নির্দিষ্ট রুকন ও
যিকরসমূহকে বিশেষ পদ্ধতিতে নির্ধারিত সময়ে আদায় করাকে সালাত বলে। ঈমান
ছাড়া অন্য চারটি রুকনের (ভিত্তির) মধ্যে এটা সর্বশ্রেষ্ঠ ও সার্বজনীন।
নামাজকে দ্বীনের খুঁটি বলা হয়, খুঁটি ছাড়া যেমন ঘর হয় না সেরূপ নামাজ
ছাড়াও দ্বীন পরিপূর্ণ হয় না।
নামাজের মর্যাদা: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: ব্যক্তি এবং শির্ক ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য হলো নামাজ ছেড়ে দেয়া। (মুসলিম)
বুরাইদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: আমাদের এবং কাফিরদের মধ্যে পার্থক্য হলো নামাজ। অতএব যে নামাজ ছেড়ে দিল সে কুফরী করল। (নাসায়ী)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরো বলেছেন:
ক্বিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার নামাজের হিসাব নেয়া হবে। যদি তা যথাযথ
হয়, তবে সে সফল হলো এবং মুক্তি পেল। যদি তা সঠিক না হয় সে ধ্বংস হলো ও
ক্ষতিগ্রস্ত হলো। (নাসায়ী)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরো ইরশাদ করেন: আমি
মানুষের সাথে সংগ্রাম করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যে পর্যন্ত তারা স্বীকার
করে নেবে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তারা নামাজ কায়িম করবে। (বুখারী)
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে জিজ্ঞেসা করলাম, কোন ‘আমল আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়? তিনি বললেন: ওয়াক্তমত নামাজ আদায় করা, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা। (মুসলিম)
নামাজ অমান্যকারীর ভয়াবহ পরিণাম: আল্লাহ তা’আলা জাহান্নামীদের প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন : তোমাদের কিসে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে? তারা বলবে, আমরা নামাজ আদায় করতাম না। (সুরা মুদদাসসির-৪২/৪৩)
জামায়াতের সাথে সালাত আদায়ের গুরুত্ব: আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন: তোমরা নামায সুপ্রতিষ্ঠিত কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।(সূরা
বাকারা-৪৩) জামাআতের সাথে নামাজ পড়ার আগ্রহ ও উতসাহ প্রদানে এবং তার
ফযীলত সর্ম্পকে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অপর দিকে জামাআত র্বজন ও জামাতের
সাথে নামাজ আদায়ে অবহেলাকারীর বিরুদ্ধে ও তার অবহেলার ক্ষেত্রে সর্তককারী
হাদীস এসেছে।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: জামাতে নামাজ পড়ার ফজীলত একা পড়ার চেয়ে সাতাশ গুণ ঊর্ধ্বে। (বুখারী ও মুসলিম)
উবাই ইবনে ফা’আর (রা) থেকে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: নামাজের প্রথম সারি হলো ফেরেশতাদের সারির মতো।
তোমরা যদি প্রথম সারির মর্যাদা সম্পর্কে জানতে তবে তা পাওয়ার জন্য
ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তে। মনে রেখ একা নামাজ পড়ার চাইতে দুই ব্যক্তির
একত্রে নামাজ পড়া উত্তম। আর দুই ব্যক্তির একত্রে নামাজ পড়ার চাইতে তিন
ব্যক্তির একত্রে নামাজ পড়া উত্তম। এভাবে যতবেশী লোকের জামায়াত হবে, তা
আল্লাহর কাছে তত বেশি প্রিয় হবে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত,
যে ব্যক্তি উত্তমভাবে পবিত্রতা অর্জন করে জামায়াতে নামাজ পড়ার জন্য কোন
একটি মসজিদের দিকে পা বাড়াবে, তার প্রতিটি কদমে আল্লাহপাক তার জন্য একটি
করে পুণ্য লিখে দেবেন। তার একটি করে মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন এবং একটি করে
পাপ মুছে দেবেন। তিনি বলেন, একবার এক অন্ধ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর
কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার এমন কেউ নেই, যে
আমাকে হাত ধরে মসজিদে আনবে। অতঃপর লোকটি মসজিদে উপস্থিত হওয়া থেকে
অব্যাহতি চায় এবং ঘরে নামাজ পড়ার অনুমতি চায়। তিনি তাকে ঘরে নামাজ পড়ার
অনুমতি দিয়ে দেন। অনুমতি পেয়ে লোকটি রওনা করে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.)
তাকে পুনরায় ডেকে পাঠান। সে ফিরে আসে। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কি
আজান শুনতে পাও? সে বললো, হ্যাঁ, শুনতে পাই। তিনি বললেন, তাহলে তুমি মসজিদে
উপস্থিত হবে। তিনি (সা) বললেন, ফজর ও এশার নামাজ মুনাফিকদের জন্য অন্যান্য
নামাজের তুলনায় অধিকতর ভারী। তোমরা যদি জানতে এই দুইটি নামাজের মধ্যে কি
পরিমাণ সওয়াব নিহিত আছে, তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও নামাজে উপস্থিত হতে।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, আল্লাহর শপথ, আমি সাহাবীগণকে দেখেছি,
তাঁরা কখনো নামাজের জামায়াত ত্যাগ করতেন না।
জামায়াত ত্যাগ করে কেবল মুনাফিক: আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: তোমাদের কারও স্ত্রী যদি জামায়াতে নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে আসতে চায়, তবে সে যেনো তাকে বাধা না দেয়। (বুখারী, মুসলিম)
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: তোমাদের স্ত্রীদের মসজিদে আসতে বাধা দিওনা। তবে তাদের জন্য তাদের ঘরে নামাজ পড়াই উত্তম। (আবু দাউদ)
ইসলামের কিছু ইবাদত একত্রিত ও
সম্মিলিতভাবে করার বিধান রয়েছে। এ বিষয়টি ইসলামের উত্তম বৈশিষ্ট্যসমূহের
একটি বলা যায়। যেমন, হজপালনকারীরা হজের সময় সম্মিলিতভাবে হজ পালন করেন,
বছরে দু’বার ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহায় (কুরবানী ঈদে) মিলিত হন এবং প্রতিদিন
পাঁচবার জামাআতের সাথে নামাজ আদায় করার উদ্দেশ্যে একত্রিত হন। জামাআতের
সহিত নামাজ মুসলিমদের মধ্যে সাম্য, আনুগত্য, সততা এবং প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের
শিক্ষা দেয়। কেননা ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা, ছোট-বড় একই স্থানে ও কাতারে
দাঁড়ায়, যা দ্বারা আন্তরকিতা সৃষ্টি হয়। দ্বন্ধ, বিচ্ছিন্নতা বিলুপ্ত
হয়।
জামাআতের সহিত নামাজ কায়েমের মধ্যে
রয়েছে মুসলিমদের সংস্কার, ঈমানের পরিপক্কতা ও তাদের মধ্যে যারা অলস তাদের
জন্য উতসাহ প্রদানের উপকরণ। জামাতের সাথে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর
দ্বীন প্রকাশ পায় এবং কথায় ও র্কমে মহান আল্লাহর প্রতি আহ্বান করা হয়,
জামাআতের সাথে নামাজ কায়েম ঐ সকল বৃহত কর্মের অর্ন্তভুক্ত যা দ্বারা
বান্দাগণ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে এবং এটি র্মযাদা ও নেকি বৃদ্ধির কারণ।
নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। ঈমান আনার
পর আল্লাহর আনুগত্যের রশি গলায় ঝুলানো হলো কি না তার প্রথম পরীক্ষা হয়ে
যায় নামাজের মাধ্যমে। আজান হওয়ার সাথে সাথে কালবিলম্ব না করে ঈমান
আনয়নকারী ব্যক্তি যখন জামায়াতের সাথে নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে গিয়ে
নামাজে শামিল হয়, তখন বোঝা যায়, কালেমাপড়ুয়া ব্যক্তিটি আল্লাহর আনুগত্য
তথা ইসলামের যাবতীয় অনুশাসন মেনে চলতে প্রস্তুত।
বাস্তব জীবনে নিজেকে মুসলমান হিসেবে
প্রমাণ করতে চাইলে অবশ্যই নামাজ আদায় করতে হবে। ঈমানের দাবী পূরণের
সর্বোতকৃষ্ট মাধ্যম হচ্ছে নামাজ। যার নামাজ নেই তার পরিপূর্ণ ঈমান নেই।
আমাদের সমাজে অনেককে বলতে শোনা যায়, নামাজ পড়ছি না বলে কি আমি মুসলমান
নই? নামাজ পড়া না পড়া ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা কত ভয়ঙ্কর কথা। ইসলাম
সম্পর্কে কী পরিমাণ দীনতা থাকলে এ ধরনের কথা বলা যায়, তা সহজেই অনুমেয়।
অথচ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে নামাজ ত্যাগ করল সে
কুফরী করল। আরেকটি হাদীসে এসেছে, কাফির ও মুসলমানের পার্থক্য হলো নামাজ।
যারা নামাজ পড়ে না অথবা নামাজে অবহেলা, গড়িমসি বা শিথিলতা প্রদর্শন করে
তাদের ব্যাপারে কুরআন বলছে: সে সব শ্রেণীর লোকদের জন্য নামাজ অত্যন্ত কঠিন কাজ, যারা আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করতে প্রস্তুত নয়। (সূরা বাকারা-৪৫)
আমাদের জানা দরকার, নামাজ পড়া বা না পড়া
ব্যক্তিগত ব্যাপার তো নিই, নামাজ একা একা আদায় করারও সুযোগ নেই। হযরত
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: যে ব্যক্তি আজান শুনে ওজর ছাড়া মসজিদে না গিয়ে
একাকী নামাজ আদায় করল, তার নামাজ কবুল করা হবে না। লোকেরা বলল, ওজর কী?
রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : ভয় ও রোগ। (আবু দাউদ) এ হাদীস থেকে বোঝা
যায়, নামাজ একাকী নয়, বরং জামায়াতের সাথেই পড়তে হবে। হযরত জিবরাইল (আ)
রাসূলুল্লাহ (সা)-কে নামাজের শিক্ষা দেয়ার সময়ও জামায়াতের ব্যবস্থাপনার
সাথে নামাজ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া কুরআনেও যতবার নামাজের প্রসঙ্গ
এসেছে ততবারই নামাজ কায়েম করার কথাই এসেছে। নামাজ কায়েম একটি ব্যাপক
অর্থবোধক শব্দ। নামাজ কায়েমের একটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে জামায়াতের সাথে
নামাজ আদায় করা। কেউ ব্যক্তিগতভাবে নামাজ আদায় করলে নামাজ কায়েম হয়েছে এ
কথা বলা যাবে না।
সূরা বাকারার প্রথম পাঁচটি আয়াতে
মুত্তাকিদের যে বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে সেখানে দ্বিতীয় গুণটি হলো:
যারা (ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে) নামাজ প্রতিষ্ঠা করে। এখানেও নামাজ প্রতিষ্ঠার
কথা বলা হয়েছে। আর কোনো কিছু প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তা একা একা সম্ভব নয়,
সেখানে সঙ্ঘবদ্ধতা তথা জামায়াত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন।
ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ নামাজ এমন এক
গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক আমল যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবাদের যুগে তা আমল
করার জন্য যদি কেউ জামাতে শামিল না হতো তবে তাকে মুসলমানই মনে করা হতো না।
সে সময় মুনাফিকরা পর্যন্ত নিজেদের মুসলিম হিসেবে জাহির করার জন্য নামাজের
জামায়াতে শামিল হতো। কুরআন ও হাদীসের উল্লেখিত বাণী থেকে স্পষ্ট
প্রতীয়মান হয় যে, জামায়াতে নামাজ আদায়ের গুরুত্ব কত। তাই আসুন,
জামায়াতে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে একটি জামায়াতবদ্ধ জিন্দেগি গড়ে তুলে
আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধরি। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে
জামায়াতবদ্ধ জীবন-যাপন করার তাওফীক দান করুন। আমীন!
No comments:
Post a Comment